দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিল- ‘বিল ডাকাতিয়া’। এটি খুলনা জেলার ফুলতলা ও ডুমুরিয়া এবং যশোর জেলার অভয়নগর ও কেশবপুর উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত। বিলটিতে চাষাবাদযোগ্য জমি রয়েছে প্রায় ৩০ হাজার একর। এক সময় বিল ডাকাতিয়ার ৫৫ শতাংশ পরিবার ছিল কৃষিজীবী। বিলটি এক সময় এ অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের জন্য ছিল আশীর্বাদ। উৎপাদন হতো প্রচুর পরিমাণ ধান, সবজি এবং মাছ। কৃষি নির্ভর অর্থনীতিতে এ অঞ্চলে তখন বিরাজ করতো একটি বর্ণাঢ্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আবহ। কিন্তু কালের বিবর্তনে সেই বিল ডাকাতিয়া এখন এ অঞ্চলের মানুষের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর একমাত্র কারণ জলাবদ্ধতা ও পানিনিষ্কাশন সমস্যা।
বিগত ১৫ বছর ধরে এ অঞ্চলের কৃষিজীবী মানুষ জলাবদ্ধতার কারণে অর্থনৈতিকভাবে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। আর গত ৫ বছর ধরে এ সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। স্থায়ী জলবদ্ধতার কারণে এ অঞ্চলের কৃষিজীবী মানুষগুলো পরিণত হচ্ছে জেলেতে। স্থানীয় বাসিন্দাদের একটি বড় অংশ অন্যত্র চলে গেছে। বিল ডাকাতিয়ার জলাবদ্ধতা নিরসনে অনেক সভা, সেমিনার, আলোচনা সভা, মানববন্ধন হলেও স্থায়ী সমাধানে সরকারের পক্ষ থেকে কোন পদক্ষেপ নেই বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ।
আরও পড়ুন: জলাশয় সংস্কার: হাওরপাড়ের মৎস্যজীবী ও কৃষকেরা আশাবাদী হয়ে উঠছেন
জানা যায়, বিল ডাকাতিয়ার অনেকগুলো পকেট গেট রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো ডুমুরিয়া উপজেলার রংপুর ইউনিয়নের মোজারগুটা, কৃষ্ণনগর, বটভিরা গ্রাম নিয়ে মোজারগুটা বিল। স্থায়ী জলাবদ্ধতার কারণে এ তিনটি গ্রামের কয়েকশ’ কৃষিজীবী পরিবারকে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। জমি থাকলেও তাতে ফসল উৎপাদন করতে না পারায় মাঝে মধ্যে তাদেরকে থাকতে হয় অনাহার অর্ধাহারে।
এছাড়া স্থায়ী জলাবদ্ধতার কারণে এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষদের দুর্ভোগের শেষ নেই। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে দুর্ভোগের মাত্রা বহুগুনে বেড়ে যায়। তখন বসতভিটা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উপাসনালয় পানির নিচে তলিয়ে যায়। বর্ষা মৌসুমে মোজারগুটা গ্রামের আড়াই থেকে ৩ হাজার মানুষের চলাচলের একমাত্র ইটের সড়কটি পানির নিচে তলিয়ে যায়। তখন তাদের আর দুর্ভোগের সীমা থাকে না।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) খুলনা অঞ্চল থেকে গত ২২ জানুয়ারি মোজারগুটা বিলের জলবদ্ধতা নিরসনে ৫টি এলএলপি পাওয়ার পাম্প স্থাপন করলেও এর সুফল নিয়ে স্থানীয় কৃষিজীবীদের মধ্যে রয়েছে নানা সংশয়।
মোজারগুটা গ্রামের কৃষিজীবি প্রভাত মন্ডল বলেন, এই এলাকা এবং এর আশেপাশের এলাকার আমরা যত মানুষ আছি, সবাই আমরা এই জমিতে চাষাবাদ করে জীবন জীবিকা চালাই। কিন্তু স্থায়ী জলবদ্ধতার কারণে আমাদের সে জীবিকা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমার ৫ থেকে ৭ বিঘা জমি থাকলেও না খেয়ে থাকতে হচ্ছে। প্রত্যেক বছর বর্ষা মৌসুমে জলবদ্ধতার কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এ বছর আমার ৩টা ঘেরের মাছ ভেঁসে প্রায় তিন লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের এই বিলে পাম্প বসাইছে কিন্তু আশেপাশের বিলগুলোতে পানি থেকে যাচ্ছে। জলাবদ্ধতা নিরসনের আশ্বাস সবাই দিচ্ছে, কিন্তু বাস্তবে কিছু হচ্ছে না।
আরও পড়ুন: চুয়াডাঙ্গায় তীব্র গরমে জলাশয়ের মাছ মরে যাচ্ছে
তিনি আরও বলেন, এ অঞ্চলের জলাবদ্ধতা রোধ করতে হলে শোলমারি সুইচগেট সংস্কার করতে হবে। ভবদহে যেমন মটর (পাম্প) বসাইছে আমাদের এখানেও এরকম মটর বসাতে হবে।
একই গ্রামের কৃষিজীবী পল্টু মন্ডল বলেন, বিল ডাকাতিয়া তলায় যাচ্ছে। আমরা ধান চাষ, মাছ চাষ, সবজি চাষ কিছুই করতে পারছি না। বর্ষা মৌসুমে রাস্তায় পানি উঠে যায়। এই পানি নিষ্কাশনের জন্য শোলমারি সুইচ গেটে মোটর বসাতে হবে, তাহলে আমাদের বিল ডাকাতিয়া উঠবে।
মোজারগুটা গ্রামের অধিবাসী ও কৃষ্ণনগর হাই স্কুলের শিক্ষক গণপতি মন্ডল বলেন, নদী নালা নেই। এখন পানি সরার আর কোন ব্যবস্থা নেই। এখানে বহু লোকের বসবাস, বহু জমি-জমা। এই এলাকায় যদি ফসল না হয় তাহলে তো এলাকার মানুষ সব মারা যাবে। এ বছর আমার নিজের ৩টা মাছের ঘের পানিতে ভেসে গেছে। সব মিলিয়ে ৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। ঋণী হয়েছি। এই মোজারগুটা বিলে ৪০০ থেকে ৫০০ একর জমি আছে। বিএডিসির লোকজন পাম্প বসানো বাবদ জমির মালিকদের কাছ থেকে বিঘা প্রতি ২ হাজার টাকা করে নিয়ে এই বিলটা উঠানোর চেষ্টা করছে।
তিনি বলেন, এলাকার উন্নয়ন হচ্ছে, সবকিছু ভালো হচ্ছে, কিন্তু আমরা খাবো কি? এই নিয়ে গবেষণা চলছে। এই এলাকার জলবদ্ধতা নিরসনে উপর মহলকে জানাই, কিন্তু জানিয়ে কাজ না হলে আমরা কি করতে পারি?
আরও পড়ুন: গোয়াহরি বিলে পলো বাওয়া উৎসব